বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষাখাত

 

সামছুল আরেফীন:

মহামারিতে বিপর্যস্ত শিক্ষাখাতের আরও একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। করোনার ধাক্কা বিদায়ী বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষাখাত। টানা দেড় বছর পর সীমিত আকারে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে এনে পাঠদান শুরু হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে অটোপাস। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা এবং নিরাপদ সড়ক ও হাফ ভাড়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ছিল আন্দোলনে। স্কুলপর্যায়ে ভর্তিতে ডিজিটাল লটারি পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। এছাড়া সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের পদোন্নতি, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। চলমান মহামারিতে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হলেও কাজে লাগানো যায়নি তার সবটুকু।

অটোপাস : করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনুষ্ঠিত হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ কারণে ২০২১ সালের শুরুতেই (৩০ জানুয়ারি) প্রকাশ করা হয় ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপাসের ফল। জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ ফলের ভিত্তিতে এবার এইচএসসি অটোপাসের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাস করেছে শতভাগ শিক্ষার্থী । জিপিএ-৫ পেয়েছে আগের বছরের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি।

সংক্ষিপ্ত আকারে পরীক্ষা : করোনা পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময়ের ৮ মাস পর ১৪ নবেম্বর শুরু হয় এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা। এতে অংশ নেয় ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী। এরপর ২ ডিসেম্বর শুরু হয় এইচএসসি পরীক্ষা। এ পরীক্ষা চলে গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সারাদেশে এসএসসিতে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৯০ জন অংশ নেয়। 

বছরজুড়ে নানা দাবিতে মাঠে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা: চার হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ, ইবতেদায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, শিক্ষার সব স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ ঈদ বোনাস, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বেতন গ্রেড-৬ করাসহ নানা দাবিতে বছরজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।

ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাইম হাসানের মৃত্যুতে ফের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলা, গণহারে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের খাতার পুনঃমূল্যায়ন, দ্রুততম সময়ে বিশেষ পরীক্ষা গ্রহণ, পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের বিচার, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকির প্রতিবাদ, বাসে হাফ ভাড়া চালুসহ নানা দাবিতে সড়কে সরব ছিল শিক্ষার্থীরা।

ডিসেম্বরের শুরুতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র-শিক্ষকরা। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্দোলন শুরু হলে নয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

পরীক্ষা নিয়ে নানা উদ্যোগ : সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত তদবির বন্ধ, অভিভাবকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমানো এবং শিক্ষায় সমতা আনার লক্ষ্যে ভর্তিতে ডিজিটাল লটারি পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে এবার। এবারই প্রথম রাজধানীর বাইরে সাতটি বিভাগীয় শহরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত করোনা পরিস্থিতিতে সময় ও অর্থ বাঁচাতে এবং ভোগান্তি লাঘবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

করোনা মহামারির সময়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আর ঝুঁকি কমাতে দেশে প্রথমবারের মত ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে শুরু হয়েছে ‘গুচ্ছ’ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা।

দেশে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রধান বিষয়গুলোতে শিক্ষাকালীন ৬০ শতাংশ এবং বাৎসরিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্যের মতো বিভাগ থাকবেনা। ২০২৩ সাল থেকে নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রধান পাঠ্য বিষয়গুলোতে ৫০ শতাংশ বছরব্যাপী মূল্যায়ন ও ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে এবং দশম শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা হবে।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে শিক্ষাকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। এখানে বছর শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। পুরো শিক্ষাক্রম ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে।

গেলো বছর করোনা পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাতিল হয়েছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ইবতেদায়ী শিক্ষাসমাপনী (ইইসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা।

প্রাণ ফেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে : করোনা ভাইরাসের কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ১২ সেপ্টেম্বর। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় প্রাণ ফেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ে।

স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালা জারি : বহুকাক্সিক্ষত বেসরকারি স্কুল ও কলেজের সংশোধিত এমপিও নীতিমালা- ২০২১ ও জনবল কাঠামো জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন নীতিমালায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নতুনভাবে নির্ধারণ হয়। এখন থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে মোট ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে প্রধান শিক্ষক পদে আবেদন করা যাবে। এর আগে অভিজ্ঞতা চাওয়া হতো ১০ বছরের।

এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৪ হাজার ৩০৪ শিক্ষক নিয়োগের জন্য তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ৩১ হাজার ১০১ জন; মাদরাসা, কারিগরি ও ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপনায় ২০ হাজার ৯৯৬ জন এবং সংরক্ষিত দুই হাজার ২০৭ জন। এখন এ নিয়োগের পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে।

শিক্ষক পদোন্নতি : দীর্ঘ অপেক্ষার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো পাঁচ হাজার ৪৫২ সহকারী শিক্ষক সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান। নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কর্মরত এসব শিক্ষককে নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির নবম গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এছাড়া, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের এক হাজার ৮৪ সহকারী অধ্যাপককে পদোন্নতি দিয়ে সহযোগী অধ্যাপক করা হয়। পদোন্নতির জন্য এখন থেকে বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের দিতে হবে ১০০ নম্বরের মূল্যায়ন পরীক্ষা। এর মধ্যে অনলাইন ক্লাসের দক্ষতার ওপর রাখা হয়েছে ১০ নম্বর।

শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন: বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমস্যা না হলেও ঘোর বিপদে পড়েছেন ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। বেতনের সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনিও বন্ধ। ফলে সংকট আরো বেড়েছে। অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুলও বিক্রি করে  দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। রাস্তার মোড়ে, স্কুলের সামনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব স্কুল বিক্রির নোটিশ ঝুলছে। পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকে। দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত। টিউশন ফির টাকায় বাড়ি ভাড়া, বিভিন্ন বিল, শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সন্তানরা লেখাপড়া করে। বর্তমানে তারা বেতন দিতে পারছে না। আবার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে সাত হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। এছাড়া এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছেন কয়েক লাখ অস্থায়ী ও খন্ডকালীন শিক্ষক। এই শিক্ষকদের বেশিরভাগ বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন থেকে রক্ষায় অন্য পেশায় যাচ্ছে।

বেশি দিন বন্ধ রাখা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ : করোনা মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবার ক্ষতির পরিধী ও ব্যাপকতা এক নয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। ইউনেস্কো করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি) মাঝারি (ভারত, ইরান) ও সর্বনিম্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (বাংলাদেশ, পাকিস্তান)। এ সব দেশে প্রতি ১০ লাখে মৃতের সংখ্যা আমেরিকা (১০ শতাংশ-১৮০০ জন), ইংল্যান্ড (৬.৫ শতাংশ-১৯০০ জন), ইতালি (৭ শতাংশ-২১০০ জন) ভারত (২ শতাংশ-২২০ জন), পাকিস্তান (০.৫ শতাংশ-৯০ জন), বাংলাদেশ (০.৫ শতাংশ-৭৫ জন)।

করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের ১৬ কোটিরও বেশি শিশুর স্কুল এক বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ।  ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এক বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখা ১৪টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। গেলো বছরের ৩ রা মার্চ জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্কুল বন্ধ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

টিকাদান কার্যক্রমে শিশু শিক্ষার্থীরা : দেশে ১ নবেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুশিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শুরু করে সরকার। শিশুরা পাচ্ছে ফাইজারের টিকা। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-শিক্ষার্থীদের টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিবন্ধনপ্রক্রিয়া ও টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাপনায় কারণে জটিলতায় পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ